মেট্রিক পাস করে সবে চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ কলেজে ভর্তি হয়েছেন খালেদা খানম। রেলওয়ে কর্মকর্তা বাবার ৬ সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়। নানা দিক থেকে বিয়ের প্রস্তাবে চিন্তা বাড়ে মা দিল আফরোজের। চিকিৎসক এক পাত্র পছন্দ হয়। মেয়ের বাবাকেও জোরাজুরিতে নিমরাজি করানো গেলো। তবে বিয়েতে মেয়ের মত জানার রেওয়াজ তখনও শুরু হয়নি।
বিয়ে হয়ে যায় খালেদার। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হলেও অসুস্থ শাশুড়ির মতের প্রাধান্যে ফেনীতে শ্বশুরের গ্রামের বাড়িতেই তার দাম্পত্য জীবনের শুরু। পরে যদিও শাশুড়িসহ স্বামীর সঙ্গে মফস্বল শহরগুলোতে কেটেছে জীবনের বড় অংশ।
ঘরের আদরের বড় দুলালী, কখনো রান্নাঘরে যেতে হয়নি। অথচ বিয়ের পর লাকড়ি জ্বালিয়ে রান্না শেখেন খালেদা খানম। শহুরে মেয়ে, ঘরের কাজ পারে না বলে শ্বশুরবাড়িতে আসা মেহমানদের বিস্ময়মাখা নানা মন্তব্য শুনতেই হচ্ছিল। কিন্তু খালেদা যেন মাটির দলা, দ্রুত সময়ে একদম নতুন ছাঁচে গড়লেন নিজেকে।
সংসারে নিপুণা হয়ে ওঠেন। হাজারটা দায়িত্ব, সন্তান, ঘরভরা মেহমান সামলান। সবার মাঝে ভারি ‘লক্ষ্মী বৌ’ বলে পরিচিতি তার। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হতো তার মায়া-মমতার। কেউ কেউ নিজের পুত্রবধূকে নিয়ে আসতেন, খালেদা খানমকে দেখে যেন শেখে।
কিন্তু এতোকিছুর মাঝে বিসর্জন হয়ে গেছে খালেদার নিজের পড়ালেখা, গান-নাচ, আরো নানা শখ-আহ্লাদ। কাছেই সরকারি স্কুল, সেখানে শিক্ষকতার সুযোগটাও ঠেলতে হলো সংসারের চাপে।
এভাবে নিজেরটুকু বিসর্জন দিতে হলেও চার সন্তানের চাহিদার কমতি যেন না পড়ে সেই চেষ্টা করে গেছেন প্রাণপণে। এ যুগের মতো একক সংসার হলে বেশ ভালোভাবেই চলতে পারতেন স্বামীর আয়ে। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন, অসুস্থ-অভাবী, দূরসম্পর্কের আত্মীয়-পরিজনসহ সবাইকে নিয়েই বাঁচতে ভালো লাগে তার।
অনেক বিষয়ে ছাড় দিলেও চার সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করা, ভালো মানুষ হিসেবে গড়ার চেষ্টায় কোনো ছাড় দেননি এই মা। নিজের সাজ-পোশাক, শাড়ি-গহনার শখ জলাঞ্জলি দিয়ে সন্তানদের ছোট ছোট চাহিদা পূরণ করে গেছেন।
আজ তার ছেলেমেয়েরা ব্যক্তিগত ও পেশা জীবনে মা-বাবার সেই দায়িত্ববোধ, ত্যাগ-বিসর্জন, মানুষের প্রতি মমতা আর সাদামাটা জীবনযাপনের শিক্ষাটা চর্চা করছেন।
তার আজীবনের ত্যাগ ও কষ্টের স্বীকৃতি হিসেবে পেলেন ‘রত্মগর্ভা’ খেতাব। শুধু খালেদা খানম নন, মোট ৩৮ জন পেয়েছেন এই খেতাব। তার মধ্যে ১৩ জনকে বিশেষ ও ২৫ জনকে সাধারণ ক্যাটাগরিতে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। খালেদা খানম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বিশেষ ক্যাটাগরিতে। এছাড়া মাই ড্যাড ওয়ান্ডারফুল পুরস্কার পেয়েছেন চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার।
আন্তর্জাতিক মা দিবসে তাদের এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। রোববার (০৮ মে) সকালে রাজধানীর ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী সেন্টার মিলনায়তনে রতœগর্ভা মায়েদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অতিথিরা। একই অনুষ্ঠানে দেওয়া হয়েছে ‘মাই ড্যাড ওয়ান্ডারফুল’ অ্যাওয়ার্ড। আজাদ প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
‘রত্নগর্ভা’ পুরস্কার পেয়ে আনন্দিত খালেদা খানম। তার এই স্বীকৃতিতে ধন্য তার ছেলেমেয়েরাও। কিন্তু এই অর্জনের আনন্দে মাতোয়ারা হতে পারছেন না রত্নগর্ভা এই মা।
২০২১ সালে ব্রেইন স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান খালেদা খানম। গলায় অপারেশনের ফলে ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না তিনি। তারপরও তার সন্তানেরা হুইল চেয়ারে করে তাকে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে এসেছেন। সবাইকে দেখে যদি তার এতটুকু ভালো লাগে, সেটাই তো তাদের স্বার্থ
আধো আধো স্বরে তিনি বললেন, এখানে এসে আমার খুব ভালো লাগছে। সব মায়েরাই কষ্ট করেন। সন্তানরা সফল হলে সেই কষ্টটা আনন্দের হয়ে যায়। আমি সবার জন্য দোয়া করি। সবার সন্তান, সবার মা-বাবার জন্য।
খালেদা খানমের স্বামী ডা. মো. আবুল কালাম। ফেনীর দাগনভূঞার কৃষ্ণরামপুরে তাদের বাড়ি। চার সন্তানের জননী এই রত্মগর্ভা। তার বড় মেয়ে সাজেদা কালাম সুইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন এটিএন নিউজের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন। বড় ছেলে ডা. মুহাম্মদ রেজাউল হক রিয়াজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস শেষ করার পর এমআরসিপি এবং এমডি সম্পন্ন করেছেন। তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ।
তৃতীয় সন্তান মো. রাশেদুল হক রাশেদ বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডায় পিএইচডি অধ্যয়রনরত। সবার ছোট শাহিদা আক্তার মিতু, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগে অধ্যয়রনরত।
***ফেনী অনলাইন সংক্রান্ত যে কোন তথ্য ও আপডেট জানতে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।***
@FeniOnline
Comments