মুহুরী প্রকল্পের অদূরে রয়েছে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ।
ফেনী নদী, মুহুরী নদী এবং কালিদাস পাহালিয়া নদীর মিলিত প্রবাহকে আড়ি বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ৪০ ফোক্ট বিশিষ্ট একটি বৃহদাকার পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরী করে এই এলাকায় বন্যার প্রকোপ কমানো ও অতিরিক্ত সেচ সুবিধা প্রদানের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল মুহুরী সেচ প্রকল্পের। এর সুবিধা এখন ভোগ করছেন সেখানকার অধিবাসীরা এবং সেই সাথে সারা দেশের মানুষ কারণ এই প্রকল্পের জন্যেই এই এলাকা পরিণত হয়েছে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকায়।
গুগল ম্যাপে মুহুরী প্রকল্পের অবস্থান।
মুহুরী নদীর ওপরে বাঁধ। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ।
হাঁটতে শুরু করলাম বাঁধের ওপর দিয়ে। পা ফেলছি আর ভাবছি যখন এই বাঁধ ছিলনা প্রমত্তা নদী দুকূল ভাসিয়ে পৌঁছাত তার শেষ গন্তব্য সমুদ্রে, সাথে নিয়ে যেত দুপাড়ের মানুষের আশা ভরসা, আর হাহাকার। আজ বাঁধ দেওয়ার ফলে সেই হাহাকারের জায়গায় আজ নদী শুনতে পায় দুপারের মানুষের আনন্দ উল্লাস। বাঁধটা পেরোলেই আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে ইট বিছানো এবড়ো থেবড়ো পথ যার দুপাশ জুড়ে রয়েছে গাছের সমাহার। মনে হবে যেন এই বন্ধুর পথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে উপলব্ধি করা যাবে জীবনের অনেক না জানাকে। দক্ষিণে বিস্তীর্ন মাঠ এবং বন বিভাগের সবুজ বেষ্টনী রয়েছে। বাঁধ পেরিয়ে নীচের দিকে নামলেই নদীর ধার ঘেঁষে বানানো হয়েছে কিছু বসার জায়গা। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে দুদণ্ড এখানে বসে জিরিয়ে নিতে পারবেন। দর্শনার্থীদের জন্য এখানে রয়েছে অস্থায়ী কিছু দোকান যেখানে আপনি পাবেন জনপ্রিয় চটপটি, ফুচকা বা ঝালমুড়ি মাখা। সবুজ কচি ডাব দেখে আর লোভ সামলানো গেলনা। মাত্র ২৫ টাকায় একটি ডাব খেয়ে প্রাণ জুড়ালাম। ডাবের সাথে বাড়তি হিসাবে পেলাম ডাবের মালাই। সবুজ গাছ গাছালিতে পূর্ণ এই জায়গায় কিছুক্ষণ প্রাণ ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে উঠে বসলাম ঘাটে বাঁধা নৌকায়। মুহুরী নদীর বুকে ভেসে চলছে নৌকা আর তাকিয়ে দেখছি চারপাশের প্রকৃতি আর জীব বৈচিত্র্য। পাখিপ্রেমীদের জন্য আদর্শ গন্তব্য মুহুরী প্রকল্প। এখানে প্রায় একশোরও বেশি দেশি প্রজাতির পাখি ছাড়াও অতিথি পাখিরও দেখা মেলে। পাখির ছবি তুলতে চাইলে খুব ভোরে পৌঁছাতে হবে মুহুরি প্রকল্পে।
মুহুরী নদীর তীর ঘেঁষে একটু খানি বিশ্রামের জায়গা। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ।
মুহুরী নদীতে নৌভ্রমণ। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ।
এখানকার জলাশয়ে আছে হাজার হাজার পাখি। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ।
বিভোর হয়ে উপভোগ করছিলাম সবুজ প্রকৃতি আর পাখিদের কলকাকলি, কিন্তু এক সময় পেট জানান দিল ক্ষুধা লেগেছে। বাঁধের দুই পাশেই রয়েছে বেশ কিছু খাবার হোটেল। এখানে সাশ্রয়ী মূল্যে পাবেন বিভিন্ন ধরণের খাবার। পাবেন নদীর বা ঘেরের নানান জাতের তাজা মাছ। স্থানীয়দের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে মৎস্য চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য চাষ এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এ মুহুরী প্রজেক্ট এলাকা। বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলেছে অনেকেই। স্থানীয়রা সবাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মৎস্য প্রকল্পের সাথে জড়িত। পরিচিত একজনের মৎস্য চাষের ঘেরে গেলাম। সেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষ করা হয়। প্রতিদিন ১০০ টনেরও বেশি মাছ এ এলাকা থেকে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, পার্বত্য এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। এ অঞ্চলের মানুষের শতভাগ মাছের চাহিদা পূরণ করে মুহুরী প্রকল্প থেকে। তাই বেড়াতে গেলে মাছ খেতে ভুলবেন না যেন।
মুহুরী সেচ প্রকল্প। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ।
মুহুরী সেচ প্রকল্পের মাত্র ৫০০ গজ দূরে খোয়াজের লামছি গ্রামে দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অবস্থিত। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলেও অল্প কিছুদিন চলার পর নানা অজুহাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলেও বায়ুকল কিংবা উইন্ডমিল গুলো তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। গোধূলির শেষ আলোয় দিগন্ত রেখার সাথে তাল মিলিয়ে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে বায়ুকলগুলো। আর তাই মুহুরী প্রকল্পে গেলে সূর্যাস্ত না দেখে ফেরাটা ঠিক হবে না।
সূর্যাস্তে মুহুরী সেচ প্রকল্পের রূপ। ছবিঃ কালপুরুষ অপূ।
বাংলাদেশের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন কেন্দ্ৰ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে মুহুরী প্রকল্প এলাকা। বহুল প্রচলিত পর্যটনস্থল গুলোতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় এড়াতে অনেকে খুঁজছেন নতুন নতুন ভ্রমণ গন্তব্য। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মাঝে অবস্থানরত এই মুহুরী প্রকল্প হতে পারে এক আদর্শ পর্যটনস্থল। এখানে এলে পাবেন আদিগন্ত জলরাশির বিপুল স্রোতের খেলা, সবুজ গাছ গাছালি, হাজার নাম না জানা পাখির কলতান। আশে পাশের মাছের ঘেরগুলোর সৌন্দর্যও দেখার মত। একটি বেলা মুহুরী নদীর ধারে শুয়ে, বসে, নদীতে নৌকায় ভেসে কাটিয়ে আবার ফিরে যাবেন ব্যস্ত নাগরিক জীবনে।
Comments