দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিসাইলের ব্যাপক উন্নতি হয়। ১৯৫৩ সালে প্রথম ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল আসে যুদ্ধের বাজারে। সাথে সাথে যুদ্ধবিমানের সক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় বহুগুণ। শব্দের চেয়েও বেশি গতিতে চলা এসব বিমানকে ভারী মেশিনগান দিয়েও ভূপাতিত করা কষ্টসাধ্য ছিল। গত শতকের ৬০/৭০ দশকের মধ্যে সাধারণ মেশিনগান দিয়ে এসব বিমান ধ্বংস করা প্রায়, অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মাঝারি মাত্রার মেশিনগান দিয়ে বিমান ভূপাতিত করার কোনো পরিসংখ্যান যদিও নেই, তবুও বলা যায় এমন দুর্লভ ঘটনা ঘটলেও সেটি একদমই হাতে গোনা দু-তিনটা হবে। আর সামরিক ইতিহাসের এরকমই এক দুর্লভ ঘটেছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। এশিয়ার স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ বাহিনীর মনোবলে তীব্র চিড় ধরেছে। এদিকে দিনে দিনে পরিণত হয়ে উঠছে মুক্তিবাহিনী। গেরিলা হামলায় টালমাটাল পাকবাহিনীকে এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত বাহিনীর সাথেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ঢাকায় ঢুকে পড়েছে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা। সামরিক নীতিনির্ধারকরা নিয়মিত অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। গোটা দেশকেই ধীরে ধীরে মুক্তাঞ্চলে পরিণত করতে হবে।
চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের প্রবেশদ্বার ফেনী। ফেনীর একদিকে ভারত, অন্যদিকে সাগর। বাকি দুদিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড। সব মিলে ভৌগলিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মুক্তিবাহিনী ফেনী থেকে বিলোনিয়া রেল স্টেশন দখলের ছক কাঁটলো। মেজর খালেদ মোশাররফ দায়িত্ব অর্পণ করেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের উপর। বিলোনিয়ার তিনদিকেই ভারত। পাক বাহিনীর অবস্থান এখানে দুটি স্থানে; পরশুরাম এবং চিতলীয়া। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম দশম এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে বিলোনিয়ায় আঘাত হানার পরিকল্পনা করেন।
দল দুটির ৮০ ভাগ সৈন্যই পুরনো বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য। আধুনিক সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষিত তারা। এছাড়া অস্ত্রেও দল দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। পরে বাড়তি হিসেবে ১নং সেক্টর থেকে আরেক কোম্পানি সেনা আনা হয়। সব মিলে ৫ ভাগে ভাগ করা হয় সেনাদের।
১। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মিজানের অধীনে দশম রেজিমেন্টের ব্রাভো কোম্পানি;
২। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট দিদারের নেতৃত্বে চার্লি কোম্পানি;
৩। হেলাল মোর্শেদের (পরে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানি;
৪। ক্যাপ্টেন মাহফুজের মুক্তিবাহিনী কোম্পানি (১ নং সেক্টরের);
৫। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানের ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি।
পরিকল্পনা ছিল মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা পাকবাহিনীর দুই ঘাঁটির মাঝে অবস্থান নিয়ে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। সামরিক পরিভাষায় একে বলে Secret Infiltration। ছোট এলাকায় এই কৌশল দারুণ কাজে লাগলেও বড় এলাকায় এই কৌশলে যুদ্ধ করা প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ। ফেনিতে এই অপারেশন করতে গেলে কিছু জায়গায় পাকবাহিনীর অবস্থানের ১০০ মিটারের মধ্যে চলে যেতে হবে!
৫ নভেম্বর রাত, ১৯৭১। রাতের অন্ধকারে একদিক থেকে দশম রেজিমেন্ট আরেক দিক থেকে দ্বিতীয় রেজিমেন্ট গোপনে ভারতের অংশ থেকে বাংলার মাটিতে প্রবেশ শুরু করে। প্রথমে ব্রাভো কোম্পানি, পরে সেকেন্ড চার্লি কোম্পানি এবং একেবারে পেছনে হেলাল মোর্শেদের ডেল্টা কোম্পানি। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ফাঁকা জায়গাগুলো দিয়ে মুহুরী নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনীর দলগুলো নীরবে এগিয়ে যায় সলিয়ার দিকে। এরপর ১ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজ তার কোম্পানি নিয়ে গুথুমা দিয়ে ঢুকে ব্রাভো কোম্পানির সামনের অংশের সঙ্গে যোগ দেন। মুহুরী নদীর পূর্বপাড়ের ধনিকুণ্ডায় এসে পড়ে আলফা কোম্পানি।
কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো বৃষ্টি। নভেম্বরের হালকা শীতকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিল। যে সময়টা হয়তো বাড়ির আঙ্গিনায় বসে চা পান করা হতো, সেই সময়টাতেই লড়তে হচ্ছে হানাদারদের বিরুদ্ধে। শীতের রাতে কোথাও বুক পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও আবার পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পথ ধরে এগিয়ে চলতে থাকে সবাই। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনারা যার যার নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিয়ে বাংকার খুঁড়তে থাকে। তবে শীতে সবার হাড়কাঁপানো অবস্থা হলেও শেষমেশ বৃষ্টি আশীর্বাদ হয়েই দাঁড়ায়। এত বড় বাহিনীর পায়ের শব্দ আর বাংকার খোঁড়ার শব্দ হারিয়ে যায় বৃষ্টির ঝুম শব্দে।
ক্ষুধা আর ক্লান্তিকে সঙ্গী করেই শেষ হয় বাংকার খোঁড়ার কাজ। পাকবাহিনীর চোখে ধুলা দিয়ে অনুপ্রবেশের কাজ শেষ।
রেললাইনের ধারের বাংকারে ছিলেন সুবেদার এয়ার আহমেদ। হঠাৎই একটি শব্দে ভোরের নীরবতা ভেঙে যায়। ফুলগাজীর দিক থেকে রেললাইন ধরে একটি ট্রলি এগিয়ে আসছে। সকালের রুটিন চেক হচ্ছে রেল লাইনের। খোশগল্পে মশগুল পাকিস্তানী সেনাদের ধারণাই নেই সামনে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।
ট্রলি বন্দুকের রেঞ্জে আসতেই বাংকার থেকে বন্দুক গর্জে উঠলো। মুহূর্তেই খতম সবাই। সুবেদার এয়ার আহমেদ বাংকার থেকে বের হয়ে মৃত পাক অফিসারের পিস্তলটি নিয়ে ফেরত আসছিলেন। এমন সময় কোথা থেকে একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তার মাথায়। গুলির শব্দে পরশুরাম এবং চিতলীয়া দুই ঘাঁটিই সতর্ক হয়ে ওঠেছিল। দুই অবস্থান থেকেই এলোপাথাড়ি পাল্টা গুলি শুরু করেছিল পাকবাহিনী। তারই একটি গুলিতে বিদ্ধ হন তিনি।
সহযোদ্ধাকে হারিয়ে প্রতিশোধের আগুনে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে মুক্তিবাহিনী। ৯ই নভেম্বর থেমে থেমে যুদ্ধ চলে সারাদিন। পাক বাহিনীর বিরামহীন আর্টিলারি শেলিংয়ে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি তারা।
বাধ্য হয়েই বিমান হামলার সহায়তা চেয়ে হেডকোয়াটারে বার্তা পাঠায় তারা। সেদিনই বিকাল ৪টায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে শুরু হয় বিমান হামলা। কিন্তু বাংকারগুলোর তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। সূর্যের আলো কমে আসায় বিমানগুলো ফিরে যায়।
তিন দিন ধরে চলা এই যুদ্ধে যেহেতু রাতে বিমান হামলা বন্ধ ছিল, তাই বিমানগুলো F-86 sabre হবার সম্ভাবনাই বেশি। স্যবর রাতে উড়তে পারতো না এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রায় সব বিমান হামলাতেই স্যবর ব্যবহার করা হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার ইরানের কাছ থেকে পুরনো ৯০টি স্যবর সংগ্রহ করেছিল, যেগুলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর বোমা ফেলতে ব্যবহার করা হয়েছিল।
বিমানগুলো ঘণ্টায় ১,০৪৬ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারতো। এই গতি শব্দের গতির প্রায় কাছাকাছি। ইতিহাসের প্রথম বিমান হিসেবে স্যাবর শব্দের চেয়েও দ্রুত গতিতে চলতে পেরেছিল। এ ধরনের বিমান মেশিনগান দিয়ে ধ্বংস করা একরকম অসম্ভব!
৮ই নভেম্বর; পাকবাহিনী বুঝে যায় আর্টিলারি দিয়েও মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটানো যাবে না। একমাত্র ভরসা বিমান হামলা।পরশুরামের দিকে থাকা পাক ঘাঁটি বেশি বিপদে ছিল, কারণ তাদের তিনদিক দিয়ে ভারত ঘেরা। বাইরে থেকে সাহায্য পাবারও উপায় নেই। অস্ত্র ফুরিয়ে আসছে।
বিকালে আবার বিমান হামলা চালাতে শুরু করে। এবার শুধু মুক্তিবাহিনীর বাংকার নয়, নিরীহ গ্রামবাসীদের ঘরবাড়ি লক্ষ্য করেও বোমা ফেলতে থাকে। বিমানগুলো বেশ নিচু দিয়েই উড়ে বোম্বিং করে যাচ্ছিল, কারণ মুক্তিবাহিনীর কাছে কোনো বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্র নেই এটা সবারই জানা। মাটি আঁকড়ে ধরে রাখা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেয় হাতে থাকা মিডিয়াম মেশিনগান (এমএমজি) দিয়েই স্যবরকে গুলি করা হবে।
একবার বোমা ফেলে চক্কর দিয়ে ঘুরে আসার সময়ের মাঝেই এমএমজির দিক পরিবর্তন করা হলো। স্যবরগুলো আবার উড়ে আসতেই গর্জে উঠলো এমএমজি। হাবিলদার হাশমতের মেশিনগান থেকে গুলি নির্ভুল আঘাত হেনেছে শত্রুবিমানে। বেশ কিছুক্ষণ আকাশে পাক খেয়ে বিমানটি ভূপাতিত হয়। বাকি বিমানগুলো বোমা ফেলার সাহস হারিয়ে ফেরত যায়। কারো কারো বর্ণনা অনুযায়ী, বিমানটি গুলি খেয়ে ফেরত যাবার পথে কুমিল্লায় বিধ্বস্ত হয়েছিল।
পাকিস্তান বিমানবাহিনী কখনোই এই ঘটনার কথা স্বীকার করেনি। তাদের ভাষ্যমতে, যান্ত্রিক ত্রুটিতে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন ঘটনা আর আছে কি? গর্বে বুক ভরে উঠলো সবার। সীমান্তের ওপারে মিত্রবাহিনীর জেনারেল হীরা খবর পেয়ে ওয়্যারলেসে অভিনন্দন জানান।
এদিকে, রাতেই মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের আর্টিলারি সাপোর্টে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। ভোরের আগেই পতন হয় দুই ঘাঁটির। ৭০ জন সৈনিক এবং ২ জন অফিসার আত্মসমর্পণ করে। নিহত হয় ১৫০ জনের বেশি। পরে পুনরায় সেনা সমাবেশ ঘটায় পাক বাহিনী এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত থেমে থেকে চলে যুদ্ধ। কিন্তু পুনর্দখল আর সম্ভব হয় না।
কিছু বীরত্বকে আসলে শব্দে প্রকাশ করা যায় না। বিলোনিয়ার যুদ্ধ ছিল এরকমই এক গল্প। প্রতিটা মুহূর্ত ছিল বীরত্ব আর নতুন ইতিহাস রচনার গল্প। যুদ্ধটা যখন মাতৃভূমি রক্ষার, তখন নতুন সব ইতিহাস সৃষ্টি হতে বাধ্য।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও পড়ে নিন এই বইগুলো
১) বাংলাদেশ জেনোসাইড এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস
২) বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ
৩) দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ
লেখক – Sartaj Alim
***ফেনী অনলাইন সংক্রান্ত যে কোন তথ্য ও আপডেট জানতে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।***
@FeniOnline
Comments