মি: রিজিনাল্ড পোর্চ নোয়াখালী জেলার কালেক্টর (১৮৭৪-১৮৭৬) থাকাকালিন ফেনী মহকুমা সৃষ্ঠি হয়। মি : পোর্চ একজন দক্ষ প্রশাসক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ১৮৭৬ সালে শাসন সৌকর্যার্থে নোয়াখালী জেলাকে সদর ও ফেনী দুইটি মহকুমায় বিভক্ত করে সদর মহকুমার ভার জেলার ম্যাজিষ্ট্রেটও কালেক্টরের হস্তে এবং ফেনী মহকুমার ভার একজন দেশীয় ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের হস্তে ন্যস্ত করা হয়।
মোঘলযুগে দুই ফেনী নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগ থানা আমিরগাঁও নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজ কোম্পানি আমলে আমীরগাঁও থানার সদর দপ্তর খাইয়ারা নামক স্থানে সরিয়ে আনা হয়। বৃটিশ আমলেও বেশ কিছুকাল থানা আমিরগাঁও অফ খাইয়ারা বলা হতো। সোনাগাজী থানা আমিরগাঁও এর একটি অংশ ছিল। ১৮৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে আমিরগাঁও এর রোশনাবাদের ছাগলনাইয়া পরশুরাম ( ত্রিপুরা জেলার অধীন) ও চট্টগ্রাম মিরশ্বরাই থানা একত্রিত করে ফেনী মহকুমা গঠিত হয়। এটি প্রায় ৫০০ বর্গমাইল বিস্তৃত ছিল। তখনও মহকুমা হেডকোয়ার্টার খাইয়ারাতে ছিল। সর্ব উত্তর প্রান্তে দেওয়ানগঞ্জ নামক ¯’ানে মুন্সীফী কাছারি ছিল। তখন ফেনীকে চারটি থানায় বিভক্ত করা হয় । থানা গুলো হলো: ফেনী , সোনাগাজী , পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া। পুরো ফেনী মহকুমার আয়তন ছিল ৩৩৯ বর্গমাইল।
১৮৮৫ সালের ৩ আইনের বিধান মতে, নোয়াখালী জেলায় ডিষ্ট্রিক বোর্ড স্থাপিত হয়। জেলার রাস্তাঘাট , খাল পয়:প্রনালী , চিকিৎসালয় , প্রাথমিক ও মধ্যবিদ্যালয়াদি এবং ফেরি ও খোয়াড় জেলা বের্ডের কর্তৃত্বাধীন । জেলা বোর্ডের অন্তর্গত সদরে ও ফেনীতে দুইটি লোকাল বোর্ড এবং হাতিয়া, সন্দীপ, লক্ষীপুর ও ফেনী এই চারিস্থানে চারটি ইউনিয়ন কমিটি স্থাপিত ছিল। সাধারণতঃ পল্লী সংস্কার কাজের ভার ইউনিয়ন বোর্ডের উপর দেওয়া হয়েছিল। তখন ফেনী মহকুমায় ইউনিয়ন ছিল ৩৭টি।
প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ রেজাউল করিম বেলালের লেখা হাট – নগর -পুর এই তিন নামেই ফেনীর ৪৩ ইউনিয়ন নিবন্ধ থেকে জানা যায়- নামের নানা রূপ আর বৈচিত্র্য নিয়ে ছড়িয়ে আছে ফেনী জেলার ৪৩ ইউনিয়ন।
একপ্রান্তে গাজী , অন্যপ্রান্তে রাম, একদিকে ভূঁঞা অন্য প্রান্তে নাইয়া। যে ইউনিয়নটি এখন কারো ধারে কাছে নেই, আছে সবার মাঝেই, ইউনিয়ন থেকে থানা- মহকুমা পেরিয়ে এখন জেলার নাম ফেনী। ফেনী থানা গঠিত হয় ১৯২৯ সালে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জেলার গুলোর মধ্যে ফেনী একটি। ৬৪ জেলার মধ্যে ফেনীর অবস্থান ৬১তম। আয়তন : ৯২৮.৩৪ বর্গ কিলোমিটার। ৪৩টি ইউনিয়নে গ্রামের সংখ্যা : ৫৭১টি।
১৮৭৬ সালে ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে ফেনী থানা যাত্রা শুরু করে। ফেনী ভাগ হয়ে পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে দাগনভূঞা, ছাগলনাইয়া থানা গঠিত হয় ১৮৭৯ সালে । পরে ছাগলনাইয়া ভাগ হয়ে ১৯৭৯ সালে ফুলগাজী থানার সৃষ্টি। এখন ৬ উপজেলার ফেনী।
১৮৮৫ সালে ফেনী ফেনী মহকুমায় ইউনিয়ন ছিল ৩৭টি। ফেনী থানায় -১৭টি, ফেনী সদরে -১২টি, পরশুরামে -৩টি, দাগনভূঞায়- ৮টি, ফুলগাজীতে- ৬টি, ছাগলনাইয়ায় -৫টি, এবং সোনাগাজীতে ৯টি ইউনিয়ন। জেলার মোট আয়তন না বাড়লেও বর্তমানে ইউনিয়নের সংখ্যা বেড়েছে। বাদ পড়েছে ফেনী ইউনিয়ন নামটি। এখন প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের প্রধান চেয়ারম্যান।
১৮৮৫ সালে ইউনিয়ন ছিল ডিষ্ট্রিক জেলা বোর্ডের অধীনে। তখন ইউনিয়ন কাউন্সিলেল প্রধান ছিলেন ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট। সে সময় ৩৭টি ইউনিয়ন বোর্ডের যারা প্রেসিডেন্ট ছিলেন:
ফেনী
১ . সিন্দুরপুর —- মুন্সী আলতাপ আলি মিয়া
২ . রাজাপুর —- মুন্সী কাজি লুৎফল হক মিয়া
৩ . পূর্বচন্দ্রপুর —- মুন্সী আলি আহমদ চৌধুরী
৪ . রামনগর —- মুন্সী বজলের রহমান চৌধুরী
৫ . উদরাজপুর —- মুন্সী মস্তাফিজের রহমান চৌধুরী
৬ . জয়লস্কর —- মুন্সী লিকিয়ত উল্লাহ মিয়া
৭ . পাঁচগাছিয়া —- মৌলবি কলিম উল্লাহ
৮ . সরিষাদি —- শ্রীযুক্ত রামকুমার সাহা
৯ . কাজিরবাগ —-শ্রীযুক্ত বিশ্বেশ্বর বণিক
১০ . ফেনী —- খানসাহেব মৌলবি বজলাল হক চৌধুরী
১১ . গোবিন্দপুর —- বাবু বরদাপ্রসন্ন দাস
১২ . মোটবি —- মুন্সী আশ্রাফ উদ্দিন ডাক্তার
১৩ . ফাজিলপুর —- মুন্সী আলি আজ্জম মিয়া
১৪ . ফরহাদনগর —- মুন্সী মহম্মদ মরতুজা মিয়া
১৫ . লেমুয়া —- মুন্সী মছলেউদ্দিন আহম্মদ
১৬ . ধলিয়া —- বাবু হলধর মজুমদার
১৭ . বালিগাঁও —- মুন্সী আবদুল গনি মিয়া
সোনাগাজী
১ . কুঠিরহাট —- মুন্সী লাল মিয়া
২ . মঙ্গলকান্দি —- মৌঃ কাজি ছৈয়দল হক
৩ . চরদরবেশ —- বাবু গৌরচন্দ্র দাস
৪ . মুতিগঞ্জ —- মৌঃ এ কে এম আবদুল ছালাম চৌধুরী
৫ . আমিরাবাদ —- মৌঃ এ কে এম ছাদেক চৌধুরী
৬ . সোনাগাজী —- মৌঃ এ এন এম বজলার ছোবাহান চৌধুরী
পরশুরাম
১ . মির্জানগর —- মৌঃ আবিদের রহমান
২ . পরশুরাম —- মুন্সী মহাম্মদজ্জমা চৌধুরী
৩ . চিথলিয়া —- বাবু রেবতী মোহন সরকার
৪ . ফুলগাজী —- মুন্সী তপজ্জল হোসেন মিয়া
৫ . বক্সমাহমুদ —- মুন্সী আক্তারজ্জামান মজুমদার
ছাগলনাইয়া
১ . মুন্সীরহাট — মুন্সী আহম্মদ আজ্জম
২ . আনন্দপুর —- মুন্সী হোসেন উদ্দিন চৌধুরী
৩ . আমজাদহাট —- বাবু বিপিন চন্দ্র চক্রবর্তী
৪ . মহামায়া —- মুন্সী মহাং ইউছুপ চৌধুরী
৫ . পাঠান নগর —- মুন্সী আবদুল আজিজ
৬ . ছাগলনাইয়া —- বাবু কুঞ্জবিহারী পোদ্দার
৭ . রাধানগর —- মুন্সী আবদুল রাজ্জাক
৮ . শুভপুর —- মুন্সী সুলতান আহম্মদ চৌধুরী
৯ . ঘোপাল —-মুন্সী হাজি আবদুল গনি ভূঁইয়া
ফেনীর সুপরিচিত ইউনিয়নের সাথে ইতিহাসের নানা উপাদান ও কিংবদন্তী যুক্ত আছে। নামের ইতিহাসের সাথে খুঁটিনাটি উপাদান ও তাদের ভূ- প্রাকৃতিক পরিচয় মেলে ধর্ম শব্দের সাথে ধর্মপুর আবার হিন্দুদের দেব দেবীর নামও এসেছে। ঘোপাল, কালিদহ, জায়লস্কর মঙ্গলকান্দি। বারো ভ’ঞা ও মাতুভ’ঞা ইউনিয়ন ফুলগাজী ও সোনাগাজী। বড় বড় শহরের নামের পিছনে নগর কিংবা পুর উল্লেখ করা হয়। মির্জানগর, পাঠান নগর, রাধানগর, রাধানগর, ফরাদনগর , রামনগর। আবার বাগান বাঁগিচায় কাজিরবাগ। গাঁও গেরামের যোগ হয়ে বালিগাঁও।
ফেনীর ইউনিয়ন নামগুলোর সাথে পুর অভিধাযুক্ত রয়েছে বেশী। ফাজিলপুর , আনন্দপুর, গোবিন্দপুর, ইয়াকুবপুর, শুভপুর, দরবারপুর, নওয়াবপুর, রাজাপুর, সিন্দুরপুর, ও পূর্বচন্দ্রপূর।
নদীরপাড়ে অবস্থিত ব্যবসা বাণিজ্যেও কেন্দ্রকেই গঞ্জ বলে মতিগঞ্জ। বাণিজ্যিক হাট বাজার নাম ছড়ায়ে মুন্সীরহাট, আমজাদহাট, জিএমহাট। আওলিয়া প্রভাবে চিথলিয়া। নৌকা বাওয়া বা নাইয়ার সাথে ছাগলনাইয়া। কায়া আর মায়ার প্রভাবে মহামায়া। বীজ বা দানার সাথে মিল রেখে বগাদানা ইউনিয়ন। নদ- নদীর পাশে চরের আর্বিভাব। যেমন: চরচান্দিয়া, চর দরবেশ, চর মজিলিশপুর,। বাদশা আমিরদেরস্মরণ করা হয়েছে- আমিরাবাদ। ৫টি ইউনিয়নের নাম এসেছেতিন অক্ষরে: ধলিয়া , মোটবী, ছনুয়া, লেমুয়া ও শর্শদি। ইতিহাসে ¯’ান /এলাকা ভিন্ন ভিন্ন কারণে বিখ্যাত আলোচিত। ফেনীর অনেক গ্রাম ও স্থান আছে যা জগৎ বিখ্যাত।
লেখক – ফিরোজ আলম
লেখক: সাংবাদিক , গবেষকও প্রাবন্ধিক
Comments