ফেনীর ছোট-বড় সবার কাছে জালালিয়ার সিংগারা পরিচিত। বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষজন জেলা শহরে এলে জালালিয়ার সিংগারা খাওয়া ছাড়া বাড়ি যায় না। তিন কোণাকার জালালিয়ার এই সিংগারা ৭৫ বছর ধরে সুনাম ধরে রেখেছে।
১৯৪৫ সালে মরহুম হাজী জালাল আহমদ ফেনী শহরের ট্র্যাংক রোড়ে কোর্ট মসজিদের পাশে ড্রেনের ওপর কাঠের পাটাতন বিছিয়ে ছোট একটি হোটেল দেন। তখনই প্রথম ওই হোটেলে তৈরি করা হয় এই সিংগারা। জালালিয়া হোটেলের নামে প্রচলিত হয় জালালিয়ার সিংগারা।
সিংগারার পাশাপাশি এখানে ভাসা তেলের পরোটা, দেশি মুরগির স্যুপ, মাটির পাত্রে কালোজাম ও লালমোহন মিষ্টি বিক্রি করতেন তিনি। কথিত আছে ভাসা তেলের পরোটা খাওয়ার জন্য জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন তখন রিকশা রিজার্ভ নিয়ে আসত এ হোটেলে।
জানা যায়, কারিগর আবদুল কাদের ও সালাম আহমদের হাতেই এ সিংগারার জন্ম। কাদের এখানে ৩০ বছর ও সালাম ৩৬ বছর সিংগারা তৈরি করেন। শুরুতে একটা সিংগারার দাম ছিল ১ আনারও কম। কিন্তু ১৯৯০ সালে হয় ২ টাকা। ২০০৩ সালে ৪টাকা, ২০১০ সালে ৫ টাকা এবং ২০১৮ সাল থেকে ৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার সিংগারার পাশাপাশি সমুচাও বিক্রি হয়। এই সিংগারার অন্যতম বৈশিষ্ট হলো এখানে সালাদ হিসেবে পেঁয়াজ কুচি ছাড়া অন্য কিছু দেয়া হয় না। বাজারে পেঁয়াজের দাম যখন চড়া ছিল তখনও সালাদে কেবল পেঁয়াজই ব্যবহার করা হতো।
মরহুম জালাল আহমদ ফেনী শহরের নাজির রোড়ের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি একজন সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। চট্টগ্রামের কুমিরাতে কাস্টম একসাইজ ভ্যাট অফিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানে হোটেল দেন তিনি। তার ৭ ছেলে, ৬ মেয়ে।
বর্তমানে পারিবারিক এই ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন দুই ছেলে। সময়ের ব্যবধানে জালালিয়া হোটেল এখন জালালিয়া সুইটসে রূপান্তরিত হয়েছে। একই জায়গায় টিনের ঘরের বদলে ৩ তলা বিল্ডিং উঠলেও ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনও বিক্রি হয় জালালিয়ার সিংগারা।
প্রধান কারিগর আনোয়ার হোসেন ১৭ বছর ধরে এই সিংগারা বানাচ্ছেন। তিনি জানান, আলু, ময়দা, বাদাম ও নিজস্ব উপায়ে সংরক্ষিত মসলা দিয়ে এই সিংগরা বানানো হয়। মূলত ভালো মানের মসলা ব্যবহার এবং নিজস্ব প্রক্রিয়া অবলম্বন করে বানানোর কারণে মানুষ এটি এত বেশি পছন্দ করেন।
জালালিয়া সুইটসের পরিচালক রাজু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে জানান, ১৯৯০ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন বড় ভাই নাসির উদ্দিন। ২০০৩ সাল থেকে তিনি দেখাশুনা করছেন। এক সময় এটি সরকার বন্দোবস্তের জায়গা ছিল। পরবর্তীতে তারা কিনে নিয়েছেন। জালালিয়া সুইটসের একটি মাত্র শাখায় এই সিংগারা বিক্রি করা হয়।
তিনি জানান, কারিগরের হাত বদলালেও ৭৫ বছরে সিংগারার স্বাদ ও মান একই রাখার চেষ্টা করেছে তারা। ১৯৪৫ সালে হোটেলের শুরুতে যে রকম আকার ছিল, যেসব উপাদান ব্যবহার করা হতো এখনো সেই একই পদ্ধতিতে এই সিংগারা তৈরি করা হয়।
তিনি আরও জানান, ফেনীর সকল প্রশাসনিক দপ্তর, স্কুল, শহরের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্থায়ী কাস্টমার। ফেনীর বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ীরা এই সিংগারার ভক্ত। তারা ফেনী এলে একবার হলেও সিংগারা খেতে ভুল করেন না।
জালালিয়া সুইটসের আরেক পরিচালক রাসেল আহমেদ জানান, এই সিংগারা গরম গরম খেতে স্বাদ তাই সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ভাজা হয়। এই সময়ের মধ্যে যখনই যাবেন গরম গরম খেতে পারবেন। ভবনের তিন তলায় ভাজার কাজ চলে। নিচ তলায় বসে কাস্টমাররা। এক সঙ্গে ২০ জন মানুষ বসে খেতে পারে। বসার জায়গা কম হওয়ায় অনেক সময় কাস্টমারদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
ফেনী শহরের স্থায়ী বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪০ বছর ধরে এই সিংগারা খাই আমি। আগের থেকে স্বাদ সামান্য কমলেও মান একই আছে। আমার পরিবারও এই সিংগারা খুব পছন্দ করে।
সিংগারা খেতে আসা অ্যাডভোকেট রাশেদ ভূঞা বলেন, আমি ২০ বছর ধরে এই সিংগারার সঙ্গে পরিচিত। সন্ধ্যা হলেই এখানে আমি সিংগারা খেতে আসি। আর কোনো সিংগারা খেতে এত স্বাদ লাগে না এটার যতটা স্বাদ।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফেনীর প্রবীণ সাংবাদিক আবু তাহের বলেন, একটা সময় ছিল যখন বিকেল বেলা জালালিয়া সিংগারা না খেলে নাস্তাই হতোনা। এখন তেমন বাইরে নাস্তা করা হয় না। তবে জালালিয়ার সিংগারা হলে খাই।
সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট
***ফেনী অনলাইন সংক্রান্ত যে কোন তথ্য ও আপডেট জানতে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।***
@FeniOnline
Comments