শিল্প, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিতে ফেনী অনেক জেলা থেকে একটি অগ্রসরমান জেলা হলেও নাটক ও চলচ্চিত্রে ফেনীর লোক তুলনামূলক ভাবে কম। অভিনেতা আনিসুর রহমান আনিস ছিলেন তাদের মধ্য্যে অগ্রগণ্য । সে বৃটিশ আমল থেকে এ দেশে মঞ্চ, বেতার টিভি ও চলচ্চিত্রের দাপটের সাথে অভিনয় করে দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন। ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার বল্লভপুর গ্রামে জন্ম নেয়া ফেনীর কৃতি সন্তান আনিস ছিলেন একজন প্রতিভাযশা কৌতুক অভিনেতা । তাঁর কৌতুক ও বাচনভঙ্গি দিয়ে তিনি লক্ষ কোটি দর্শককের হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন। পেয়েছিলেন ‘হাসির রাজার’ খেতাব। তাঁর সাথে যারা বাংলা চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনয় শুরু করেছিলেন খান জয়নুল , সাইফুদ্দিন, আনিস, আশীষ কুমার লোহ, রবিউল, হাসমত, মতি, দিলদার সদ্য প্রয়াত টেলিসামাদ আগেই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন । এবার গেলের কৌতুকের রাজা আনিস।। কৌতুক অভিনেতারা তাদের অভিনয়ে দর্শকদের নির্মল আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
মৃত্যুকালে আনিসের বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি দুই মেয়ে রেখে গেছেন। । অনিসের জন্ম ১৯৪১ সালে জলপাইগুড়িতে । আনিসের বাবা মরহুম আমিনুর রহমানের চা-বাগানের ব্যবসা ছিল জলপাইগুড়িতে। বাবার ব্যবসার কারণে ফেনীর আমিনুর রহমানকে ওখানেই থাকতে হতো। তাই আনিসের জন্মও হয় সেখানেই। একটু বেশি দেরিতে দাঁত উঠেছিল বিধায় পরিবারের অনেকেই আনিসকে ‘বুড়া’ বলে ডাকতেন। একসময় জলপাইগুড়ি ছেড়ে আনিসদের পরিবারকে গ্রামে চলে আসতে হলো। সেখানেই আনিসের পড়াশোনা শুরু। স্কুলজীবনে ‘ড্রেস এজ ইউ লাইক’ অনুষ্ঠানে আনিস নিজে মনের মতো সাজতেন।
১৯৬৫ সালে খালাতো বোন কুলসুম আরা বেগমকে ভালোবেসে বিয়ে করেন আনিস। ৪৯ বছর একসঙ্গে সংসার করেছেন তারা। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে এতটুকু ছেদ পড়েনি তাদের ভালোবাসায়।
ষাটের দশকের শুরুতেই ঢাকায় আসেন আনিস। বড় ভাই লুৎফর রহমান এফডিসিতে চাকরি করতেন। বড় ভাই তাকে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার সাঈদুর রহমানের স্টুডিওতে কাজ দিলেন। আনিস শুরু করলেন ফটোগ্রাফির কাজ। বড় ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে আনিস এফডিসিতে সম্পাদনার চাকরি নিলেন। সেখানে পরিচয় হয় ক্যামেরাম্যান সাধন রায়ের সঙ্গে। তিনিই তাকে প্রথম উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দিলেন। তার প্রথম সংলাপ ‘আহ একটা কথা বুঝনা কেন নানী, ওই মাইয়া আমাগো ঘরে আইলে কপাল খুইলা যাইব।’ কিন্তু ক্যামেরাম্যান পরিচালককে বললেন, ‘এই মাল কোত্থেকে আনছেন, না আছে গলা, না চেহারা’। এই কথা শুনে আনিস পালিয়ে আসেন। পরবর্তীতে জিল্লুর রহিমের ‘এইতো জীবন’ চলচ্চিত্র দিয়ে শুরু হয় আনিসের অভিনয় জীবন। এটি ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। সেই সময় তিনি চলচ্চিত্রের সম্পাদনার কাজ করতেন প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা এহতেশাম ও মুস্তাফিজের সঙ্গে। অভিনয়ে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় সম্পাদনার কাজ তাকে একসময় ছেড়ে দিতে হলো।
২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক ছবিতে কৌতুকের মতো কঠিন অভিনয়টি সহজ ও সাবলীলভাবে করে অনবরত দর্শক হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেছেন তিনি। চলচ্চিত্র ছাড়াও অসংখ্য রেডিও ও টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন।নবাব সিরাজ-উদ- দৌলা নাটকে গোলাম হোসেন চরিত্রে অভিনয় করে তিনি মঞ্চে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
আনিস বাংলা চলচ্চিত্রের এক দূর্দান্ত অভিনেতার নাম। তিনি প্রথম উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। এই চলচ্চিত্রে ‘আহ একটা কথা বুঝনা কেন নানী, ঐ মাইয়া আমাগো ঘরে আইলে কপাল খুইলা যাইবো’ সংলাপটিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু সে সময় ক্যামেরাম্যান পরিচালককে বললেন, ‘এই মাল কোত্থেকে আনছেন আপনি, না আছে গলা, না আছে চেহারা’। এই কথা শুনে আনিস পালিয়ে আসেন। পরবর্তীতে জিল্লুর রহিমের ‘এইতো জীবন’ চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে শুরু হয় আনিসের অভিনয় জীবন। এটি ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়।
আনিস একাধারে একজন চলচ্চিত্রাভিনেতা, রেডিও আর্টিস্ট এবং নাট্য অভিনেতা ছিলেন। তাকে টিভিতে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন কলিম শরাফী। আবার রেডিওতে অভিনয় করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন খান আতাউর রহমান। তিনি এহতেশাম ও মুস্তাাফিজের লিও দোসানী ফিল্মসে সহকারী সম্পাদক ও পরিচালক ছিলেন।
দীর্ঘ অভিনয় জীবনে নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন আনিস নায়করাজ রাজ্জাক, ফারুক ও শাকিব খানের সঙ্গে। নায়িকাদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন শবনম, সুজাতা, শাবানা ও শাবনূরের সঙ্গে। এক স্বাক্ষাৎকারে আনিস বলেছিলেন- এ পর্যায়ে আসার পেছনে যাদের ভূমিকা ছিল ব্যাপক তারা হলেন= এহতেশাম, মোস্তাফিজ, কাজী জহির, কামাল আহমেদ, আজিজুর রহমান, ই আর খান মামা, উত্তম আকাশসহ আরও বেশ কয়েকজন পরিচালক।
২০১৫ সাল। কথা ছিল প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে ঘটা করে পরের বছর ৫০তম বিবাহবার্ষিকী পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হাসির রাজা আনিস। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তার আগেই আনিসকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন স্ত্রী কুলসুম আরা বেগম। ২০১৫ সালের ঈদুল আজহার তিন দিন আগে হঠাৎ করেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। স্ত্রীকে হারানোর শোকে মুহ্যমান কৌতুকাভিনেতা আনিস আর কখনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন না বলে ঘোষণা দেন। অসময়ে স্ত্রীকে হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এই অভিনেতা। একদিন আলাপে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ওর অনুপ্রেরণাতেই অভিনেতা আনিস এবং সফল স্বামী ও বাবা হতে পেরেছি। যে আমাকে পথ দেখিয়ে আজকের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে সে-ই যখন রইল না তখন আর অভিনয় করে কী হবে।
২০১৫ সালে প্রিয়তমা স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পর টিকাটুলীর অভয়দাশ লেনের বাসায় বড় অসহায় অবস্থায় দিন গুজরাণ করেছেন হাসির রাজা আনিস। যে অভিনেতা কখনো কাঁদতে জানেননি, সবাইকে শুধু হাসিয়েছেন স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি শুধু কেঁদেছেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছেন এবং সবার কাছে দোয়া চাইতেন জীবনসঙ্গিনী কুলসুম আরা যেখানেই থাকুক যেন ভালো থাকে। বাসা থেকে তেমন একটা বের হতেন না। নামাজ রোজা নিয়মিত আদায় করতেন। বেশির ভাগ সময় বিমর্ষ হয়ে থাকতে দেখা যেত তাকে।
আনিস সর্বশেষ অভিনয় করেছেন উত্তম আকাশ পরিচালিত ‘যেমন জামাই তেমন বউ’ চলচ্চিত্রে। কার অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘এই তো জীবন’, ‘পয়সে’, ‘মালা’, ‘জরিনা সুন্দরী’, ‘জংলী মেয়ে’, ‘মধুমালা’, ‘ভানুমতি’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘সূর্য ওঠার আগে’, ‘অধিকার’ ‘অঙ্গার’, ‘বারুদ’, ‘ঘর সংসার’, ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’, ‘ পুরস্কার’ ‘লাল কাজল’, ‘ নির্দোষ’ , ‘সানাই’ , ‘উজান ভাটি’, ‘তালাক’ ইত্যাদি। তিনি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি’র অনেক পর্বে অভিনয় করেছেন।
আনিসেরা যুগে যুগে আসে না। ফেনীর এ কৃতি সন্তান অভিনেতা আনিস অনেক নাটক ও অভিনয়ে ফেনীর আঞ্চলিক ভাষাকে সাবলীরভাবে উপস্থাপনা করে তুলে ধরতেন । ফেনীর ছেলে হিসাবে ফেনীই ছিল তাঁর প্রাণ । তাইতো মৃত্যুর পর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর কবর হয়েছে ফেনীর ছাগলনাইয়ার বল্লভপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক : ফিরোজ আলম
সাংবাদিক , গবেষক ও প্রাবন্ধিক
***ফেনী অনলাইন সংক্রান্ত যে কোন তথ্য ও আপডেট জানতে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।***
@FeniOnline
Comments